
ডেক্সট রিপোর্ট:এইচ,কে খালেদ সাইফুল্লাহ
*বাংলাদেশ-ইসরায়েল বাণিজ্য: সম্পর্কহীনতার মধ্যেই লাখো ডলারেররপ্তানি
*— ফিলিস্তিন সংহতির ঘোষণার বিপরীতে ইসরায়েলে পরোক্ষ বাণিজ্যের দ্বন্দ্ব*
**ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান সংঘাত**
১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পথ সুগম হয়। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্র পশ্চিমা সমর্থনে গত ৮ দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজা ও রাফায় চালানো অব্যাহত বোমা হামলায় হাজারো নিরীহ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা কুড়িয়েছে ।
**বাংলাদেশের অবস্থান ও বাণিজ্যের অদ্ভুত দ্বৈততা**
বাংলাদেশ ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং কোনো কূটনৈতিক বা আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই। তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এর তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে ইসরায়েলে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির পরিমাণ প্রায় **১৩ লাখ মার্কিন ডলার** । এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৬.৫ লাখ ডলারের পণ্য পাঠানো হয়, যার মধ্যে রয়েছে যক্ষা, ম্যালেরিয়া ও কুষ্ঠরোগের ভ্যাকসিন ও ওষুধ, তৈরি পোশাক এবং ফার্নিচার ।
**কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এই রপ্তানি?**
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের মতে, ইসরায়েলি ক্রেতারা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করেন। উদাহরণস্বরূপ, একটি পোশাক ইউরোপীয় কোনো দেশের ঠিকানায় পাঠানো হয়, সেখান থেকে তা পুনঃরপ্তানি হয় ইসরায়েলে। ইপিবির রেকর্ডে এগুলো সরাসরি ইসরায়েলগামী বলে চিহ্নিত হয় । সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে যোগ করেন, “ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনে গন্তব্য নির্ধারণ করেন। ইসরায়েলের বাজারে পণ্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত এখান থেকেই নেওয়া হয়” ।
**আমদানির গোপন রহস্য**
ইপিবির কাছে ইসরায়েল থেকে সরাসরি আমদানির তথ্য না থাকলেও জাতিসংঘের কম ট্রেড ডাটাবেস অনুসারে, গত দেড় দশকে বাংলাদেশ ইসরায়েল থেকে প্রায় **৩৮ লাখ ডলার** মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে । বিশেষজ্ঞরা এই দ্বিমুখী বাণিজ্যকে “নীতিগত দ্বন্দ্ব” হিসেবে চিহ্নিত করে প্রশ্ন তুলেছেন: ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ঘোষণার সাথে এই বাণিজ্যিক লেনদেন কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?
**ফিলিস্তিনে রপ্তানি: নৈতিক অবস্থানের প্রতিফলন?**
একই সময়ে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনে রপ্তানি করেছে প্রায় **৪.৫ লাখ ডলারের** পণ্য, যার ৮০%以上 তৈরি পোশাক । এই রপ্তানি বাংলাদেশের নৈতিক অবস্থানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলেও ইসরায়েলের সাথে পরোক্ষ বাণিজ্য নীতিগত অস্পষ্টতা তৈরি করেছে।
**বিক্ষোভ ও নীতির দ্বিধা**
১২ এপ্রিল ২০২৫-এ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় ১ লাখ মানুষ ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে সমবেত হন। বিক্ষোভকারীরা নেতানিয়াহু, ট্রাম্প ও মোদির পুতুল পুড়িয়ে ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলন করেন । এই ঘটনা বাংলাদেশের জনমতের জোরালো প্রতিফলন, যা সরকারি নীতির সাথে বাণিজ্যিক বাস্তবতার বৈপরীত্যকে আরও স্পষ্ট করে।
**বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ**
ড. মোয়াজ্জেমের মতে, “এই দ্বৈততা দূর করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ইপিবি এবং রপ্তানিকারকদের মধ্যে জরুরি আলোচনা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় নীতি ও বাণিজ্যের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দীর্ঘমেয়াদে ভূরাজনৈতিক জটিলতা তৈরি করতে পারে” ।
**উপসংহার**
ফিলিস্তিনের প্রতি বাংলাদেশের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ইসরায়েলের প্রতি আনুষ্ঠানিক অস্বীকৃতির মধ্যেও বাণিজ্যিক স্বার্থ কীভাবে টিকে আছে—এটি একটি জটিল প্রশ্ন। তৃতীয় দেশের মাধ্যমেই হোক বা গন্তব্যের অস্পষ্টতাই হোক, এই লেনদেন রাষ্ট্রীয় নীতির পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দ্বন্দ্বের সমাধান না হলে ভবিষ্যতে কূটনৈতিক ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ আরও তীব্র হবে ।